চীনের মহাপ্রাচীর সম্পর্কে জানা অজানা সব তথ্য
চীনের মহাপ্রাচীর(The Great Wall of China) সম্পর্কে জানা অজানা সব আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর তথ্য
পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য খ্যাত চীনের মহাপ্রাচীর |
চীনের মহাপ্রাচীর (Great Wall of China):
চীনের মহাপ্রাচীর (Great Wall of China) পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর এবং ঐতিহাসিক একটি স্থাপনা। এটি শুধু চীনের ইতিহাসের নয়, বরং গোটা মানব সভ্যতার এক অমূল্য নিদর্শন। এই প্রাচীর এতোটাই বিশাল যে, একে "পৃথিবীর দীর্ঘতম স্থাপত্য" বলা হয়। হাজার হাজার বছরের নির্মাণ ইতিহাস, অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী, এবং অজানা রহস্যে ঘেরা রয়েছে চীনের মহাপ্রাচীর। আজ আমরা চীনের এই মহাপ্রাচীরের নানা জানা-অজানা, বিস্ময়কর তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
চীনের মহাপ্রাচীরের ইতিহাস:
মহাপ্রাচীর নির্মাণের শুরু:
চীনের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে। যখন বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্য নিজেদের রক্ষা করতে প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেছিলো। পরবর্তীতে প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং (Qin Shi Huang) খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে চীন অধিকৃত করার পর, এসব বিচ্ছিন্ন প্রাচীরগুলো একত্রিত করেন এবং একটি বিশাল সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেন।
মহাপ্রাচীরের নির্মাণের ধাপ:
মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ একদম প্রাচীন চিন রাজবংশ থেকে শুরু হয়ে মিং রাজবংশ (1368–1644 খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত চলেছিলো। মিং যুগের মহাপ্রাচীরই বর্তমানের দেখা মহাপ্রাচীরের সবচেয়ে বড় অংশ তৈরি করে।
নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান:
চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণে স্থানভেদে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- মরুভূমির কাঁকর এবং বালি, পাহাড়ি অঞ্চলের পাথর, আর সমতল অঞ্চলের ইট এবং মাটি ব্যবহার করা হতো। মিং যুগে প্রথমবার ইটের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
চীনের মহাপ্রাচীরের (Great Wall of China) দৈর্ঘ্য ও বিস্তৃতি:
চীনের মহাপ্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার (১৩,১৭১ মাইল)। এটি চীনের পূর্বে বোহাই সাগর থেকে পশ্চিমে গুবি মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি প্রায় ১৫টি চীনা প্রদেশ, শহর এবং অঞ্চল অতিক্রম করেছে।
চীনের মহাপ্রাচীর সম্পর্কে অদ্ভুত ও চমকপ্রদ কিছু তথ্য:
১. চীনের মহাপ্রাচীর মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান?
অনেকের ধারনা, চীনের মহাপ্রাচীর মহাকাশ থেকে খালি চোখে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে এটি সত্য নয়। NASA জানিয়েছে, মহাপ্রাচীরটি মহাকাশ থেকে খালি চোখে দেখা যায় না। যদিও কিছু নির্দিষ্ট আলোক ও আবহাওয়া পরিস্থিতিতে সেটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যেতে পারে।
২. মহাপ্রাচীর নির্মাণে অংশ নিয়েছিল লাখ লাখ শ্রমিক:
প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক, বন্দী, সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ এই মহাপ্রাচীর নির্মাণে কাজ করেছিলেন। অনেকে নির্মাণের সময় মারা গিয়েছিলেন। তাদের কিছু মৃতদেহ নাকি প্রাচীরের ভেতরেই কবর দেওয়া হয়েছিলো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে আধুনিক ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এটি কিছুটা অতিরঞ্জিত ধারণা।
৩. চীনের মহাপ্রাচীরের ভগ্নাংশ:
চীনের মহাপ্রাচীরের বেশিরভাগ অংশ আজ ভেঙে পড়েছে বা নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব অংশ মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিলো, সেগুলো প্রাকৃতিক ক্ষয় এবং মানবসৃষ্ট ধ্বংসের ফলে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
৪. প্রতিরক্ষার জন্য নয় শুধু, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিলো:
চীনের মহাপ্রাচীর কেবল প্রতিরক্ষার জন্য নয়, বরং সামরিক বার্তা আদান-প্রদানের জন্যও ব্যবহৃত হতো। টাওয়ারগুলোতে ধোঁয়ার সংকেত এবং আগুন জ্বালিয়ে শত্রুর আগমনের বার্তা পাঠানো হতো।
৫. একাধিক মহাপ্রাচীর:
চীনের মহাপ্রাচীর আসলে একটি নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে তৈরি হওয়া অনেকগুলো প্রাচীরের সমষ্টি। এসব প্রাচীর বিভিন্ন রাজবংশ দ্বারা নির্মিত হয়েছিলো, এবং সবগুলো একটানা নয়। একটার পর আরেকটা।
চীনের মহাপ্রাচীরের (Great Wall of China) সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
চীনের মহাপ্রাচীর কেবলমাত্র স্থাপত্য বিস্ময় নয়। এটি চীনা জাতির সাহস, অধ্যবসায় এবং ঐক্যের প্রতীক। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো মহাপ্রাচীরকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান (World Heritage Site) হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া, এটি "নতুন সাতটি বিশ্ব বিস্ময়" (New Seven Wonders of the World) এর অন্যতম।
চীনের মহাপ্রাচীর রক্ষণাবেক্ষণের চ্যালেঞ্জ:
বর্তমানে চীনের মহাপ্রাচীরের রক্ষণাবেক্ষণ একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পর্যটকদের অসতর্কতা, অবহেলা এবং অবৈধ নির্মাণ মহাপ্রাচীরের ক্ষতির জন্য দায়ী। চীনা সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলিতভাবে এর সংরক্ষণের জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
চীনের মহাপ্রাচীর (Great Wall of China) সম্পর্কে বিস্ময়কর কিছু তথ্য:
চীনের মহাপ্রাচীর ভ্রমণ: পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ
চীনের মহাপ্রাচীরের কিছু বিখ্যাত অংশ হলো:
বাডালিং (Badaling): বেজিংয়ের কাছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ।
মুতিয়ানইউ (Mutianyu): অপেক্ষাকৃত কম ভিড়, পরিবারসহ ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ।
জিনশানলিং (Jinshanling): ট্রেকিংয়ের জন্য চমৎকার।
সিমাতাই (Simatai): রাতের ভ্রমণের জন্য খুবই সুপ্রসিদ্ধ এবং খ্যাত।
চীনের মহাপ্রাচীর ভ্রমণের সময় পর্যটকদের জন্য পরামর্শ:
আরামদায়ক পোশাক ও জুতা পরিধান করুন।
প্রচুর পানি সাথে রাখুন।
আবহাওয়া অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন।
চীনের মহাপ্রাচীর (Great Wall of China) কেবল পাথর, ইটের তৈরি একটুখানি প্রাচীর নয় — এটি মানবজাতির ঐকান্তিকতা, সাহস এবং নিরলস প্রচেষ্টার এক অনন্য প্রতীক। হাজার হাজার বছর ধরে এটি দুনিয়ার অন্যতম বিস্ময় হিসেবে টিকে আছে। আজও, চীনের মহাপ্রাচীর বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে, অনুপ্রাণিত করে। চীনের মহাপ্রাচীর তাই গোটা পৃথিবীর একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
FAQ: চীনের মহাপ্রাচীর সম্পর্কে সাধারণ কিছু প্রশ্নোত্তর:
১. চীনের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ কত বছর ধরে চলেছিলো?
–চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ কাজ খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছে, প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন অংশ নির্মিত হয়েছে।
২. মহাপ্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য কত?
–চীনের মহাপ্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার।
৩. মহাকাশ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর দেখা যায় কি?
–না, খালি চোখে মহাকাশ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর দেখা সম্ভব নয়।
৪. মহাপ্রাচীরের কোন অংশ সবচেয়ে জনপ্রিয়?
–মহাপ্রাচীরের বাডালিং (Badaling) অংশ সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে।
কোন মন্তব্য নেই