সাদ্দাম হোসেন: ইরাকের একনায়ক থেকে পতনের ইতিহাস
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন: ইরাকের একনায়ক থেকে পতনের ইতিহাস
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন |
সাদ্দাম হোসেন কে:
সাদ্দাম হোসেন, ইরাকের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এক বিতর্কিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার শাসনামল ছিল অত্যন্ত কঠোর, দমনমূলক এবং যুদ্ধবহুল। এই আর্টিকেলে আমরা তার জীবনের শুরু থেকে শাসনকাল, যুদ্ধ, পতন এবং মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
সাদ্দাম হোসেনের শৈশব ও প্রাথমিক জীবন:
সাদ্দাম হোসেন ১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল ইরাকের আল-আউজা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মারা যান তার জন্মের পূর্বে। তিনি তার মামার সাথে বসবাস করতে বাগদাদে চলে যান। ১৯৫৭ সালে তিনি বাথ পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ সালে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আব্দ আল-করিম কাসেমকে হত্যার চেষ্টা করেন, যা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনার পর তিনি সিরিয়া ও মিশরে পালিয়ে যান এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩ সালে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। কিন্তু একই বছর তারা ক্ষমতা হারায়। সাদ্দাম হোসাইন কারাবন্দি হন। তিনি কারাগার থেকে পালিয়ে বাথ পার্টির পুনরুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৬৮ সালে দলটি পুনরায় ক্ষমতায় আসে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে উত্থান:
১৯৭৯ সালে সাদ্দাম হোসেন ইরাকের রাষ্ট্রপতি হন। তিনি গোপন পুলিশ বাহিনী ও কঠোর দমননীতি ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করেন এবং নিজেকে একটি ব্যক্তিত্ব পূজার কেন্দ্রে পরিণত করেন। তার লক্ষ্য ছিল ইরাককে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং পারস্য উপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করা।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮):
১৯৮০ সালে সাদ্দাম ইরানের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল আক্রমণ করেন। যা আট বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ উভয় দেশের জন্য অত্যন্ত বিপর্যয় ডেকে এনেছিলো। এই যুদ্ধের কারনেই ইরাকের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ শেষে উভয় পক্ষ একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়।
কুয়েত আক্রমণ ও উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯০-১৯৯১):
১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে। যার ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা এবং জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ইরাককে কুয়েত থেকে বিতাড়িত করে। এই পরাজয়ের পর ইরাকে শিয়া ও কুর্দিদের বিদ্রোহ দমন করা হয়। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হয়।
ইরাকের উপর নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক চাপ:
উপসাগরীয় যুদ্ধের পর জাতিসংঘ ইরাকের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং অস্ত্র পরিদর্শক পাঠায়। সাদ্দাম এই পরিদর্শকদের সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। যার ফলে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকের উপর বিমান হামলা চালায়। এই সময়ে সাদ্দাম তার পুত্রদের উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করতে থাকেন।
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ ও পতন:
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে হামলা চালায়। তারা অভিযোগ করে যে ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে। সাদ্দাম এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু ২০ মার্চ, ২০০৩ সালে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ৯ এপ্রিল, বাগদাদের পতন হয় এবং সাদ্দাম আত্মগোপন করেন। ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালে তাকে তার জন্মস্থান টিকরিতের কাছে একটি গোপন স্থানে আটক করা হয়।
সাদ্দাম হোসেনের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড:
২০০৫ সালে সাদ্দামের বিচার শুরু হয়। যেখানে তাকে ১৯৮২ সালে দুজাইল শহরে ১৪৮ শিয়া মুসলিম হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। বিচার চলাকালীন তিনি আদালতকে অবৈধ বলে দাবি করেন এবং বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যঙ্গ করেন। ২০০৬ সালের ৫ নভেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ৩০ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির সময় তিনি কোরআন হাতে ছিলেন এবং মুখে কালেমা পাঠ করছিলেন।
মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক:
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড ইরাকে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। শিয়া সম্প্রদায় সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কে ঘিরে উৎসব উদযাপন করে। এতে সুন্নি সম্প্রদায় তাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে এবং দাবি করে যে এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করেনি। ফাঁসির ভিডিও ফাঁস হয়ে যায়, যেখানে দেখা যায় সাদ্দামকে ফাঁসির সময় অপমান করা হচ্ছে।
সাদ্দাম হোসেনের শাসনকাল ছিলো ইরাকের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়। তার কঠোর শাসন, যুদ্ধ, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ইরাককে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন করে। তার পতনের পর ইরাক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। যার মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। সাদ্দামের জীবন ও শাসন আমাদের জন্য একটি শিক্ষা, যে ক্ষমতার অপব্যবহার একটি জাতিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই